প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি কি চাঁদাবাজ শিক্ষকদের অভয়ারণ্য?

জাকির আহমদ খান কামাল
প্রকাশ : ১৪ জুলাই ২০২৫, ০১:০২ দুপুর

বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো প্রধান শিক্ষকদের রিট পিটিশন নম্বর ৩২১৪/২০১৮ এর বিপরীতে মহামান্য হাইকোর্টের রায়ের প্রেক্ষিতে প্রধান শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড বাস্তবায়ন, সদ্য জাতীয়করণকৃত শিক্ষকদের অর্থমন্ত্রণালয় কর্তৃক ১২ আগস্ট ২০২০ তারিখের টাইমস্কেল সংক্রান্ত চিঠি প্রত্যাহার সহ তিন দফা, সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেট সহ শতভাগ পদোন্নতি এবং সহকারি শিক্ষক পদকে এন্ট্রি পদ ধরে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করা।
এসব সমস্যার সমাধানকল্পে বহুধাবিভক্ত প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দ পৃথক পৃথক প্লাটফর্ম থেকে আন্দোলন করে যাচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষকদের আন্দোলন, বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির হাত ধরেই আবির্ভূত হয়েছে।
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২০ ফেব্রয়ারি ময়মনসিংহ প্রেস ক্লাবে এক কর্মী সম্মেলনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির নাম পরিবর্তন করে "বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি" নামকরণ করা হয়। অধ্যাপক আবুল কালাম আজা দ সভাপতি নির্বাচিত হন। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে ১জুলাই ১৯৭৩ খ্রীঃ থেকে সারাদেশের ৩৬১৩৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদসহ ১৫৫২২৩ জন শিক্ষকদের জাতীয়করণ করা হয়। তারপর থেকেই সময়ে সময়ে ন্যায় সংগত বিভিন্ন দাবি নিয়ে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি কাজ করেছে।
২০০৮ সালে আদালতের রায়ে অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ সভাপতির পদ হারান। সিনিয়র সহ- সভাপতি মোহাম্মদ নুরুল আবছার সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কাজী আ কা ফজলুল হক তখন পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ২০০৮ সালের ১ মে ঢাকার ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্টিত হয়। কাউন্সিলে মোঃ নুরুল আবছার সভাপতি ও মোঃ সিদ্দিকুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
৪ বছর পর ২০১২ সালের ১০ ই ফেব্রুয়ারি একই স্থানে পরবর্তী কাউন্সিল অনুষ্টিত হয়। কাউন্সিলে আবুল বাসার সভাপতি এবং মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম তোতা সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই সময় ১০ দফা দাবি নামা গ্রহন করা হয়। ২০১৩ সালে ১০ দফার ভিত্তিতে শিক্ষকরা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ফলে ২০১৪ সালের ৯ মার্চ সরকার প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণি এবং সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেল উন্নীত করেন। তারপর থেকেই মূলতঃ বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির অস্থিত্ব সংকট শুরু হয়। একই নামে বহুধা বিভক্ত সংগঠনের আবির্ভাব ঘটতে থাকে। সবার নাম আমার জানাও নেই। আর যাদের নাম জানা আছে তাদের নাম বলে খাটো করতে চাইনা কিন্তু কেউ সংগঠনের নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে দাঁড়াতে পারেনি।
সবাই নেতৃত্বের শীর্ষে অবস্থান করতে বেপরোয়া। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সাইনবোর্ডে সেলফি দিয়ে বা উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ছবি তোলে ফেবুতে পোস্ট করেই কোন না কোন সংগঠনের পদবী যোগ করে নেতা হয়ে যায়। কখনও কখনও গভীর রাতে ফেবুর লাইভে এসে বক্তব্য রেখে সমকালীন সমস্যার সমাধান কল্পে দাওয়াই দিয়ে নিজের নেতৃত্ব জাহির করে থাকে। এসব নেতারা কখনও সাধারণ শিক্ষকদের প্রতিনিধিত্ব করে না। কারন সাধারণ শিক্ষকদের মনোনয়নের মাধ্যমে কোন শিক্ষককে নেতৃত্বের আসনে পাঠানো হয়নি। শুধু তাই নয় চাঁদাবাজির মামলায় শাস্তি পেয়েও লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বীরদর্পে নেতৃত্বের আসনে বসে আছে, অনুভূতিতে এতটুকুও নাড়া দেয় না।
এসব ফেবুক সর্বস্ব কতিপয় নেতৃত্বের কারনেই চাঁদাবাজির দায় নিয়েই আজকে পুরু শিক্ষক সমাজকে অপবাদ সইতে হচ্ছে। সম্প্রতি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম এনডিসি (পলিসি ও অপারেশন) বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়েছেন ৪৫ জন প্রধান শিক্ষকদের ১০ম গ্রেডে উন্নীতকরণে অর্থমন্ত্রনালয়ের জন বিভাগ ৩২১৪/২০১৮ নং রিট পিটিশনের রায় বাস্তবায়নের সম্মতি প্রদান করে এবং অবশিষ্ট প্রধান শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড বাস্তবায়নের বিষয়টি সরকারের সক্রিয় বিবেচনাধীন রয়েছে। এ বিষয়কে কেন্দ্র করে কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহল প্রধান শিক্ষকদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি/আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করছে মর্মে বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পেয়ে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলকে কোন রুপ আর্থিক লেনদেন না করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। শুধু তাই নয় এটি ফৌজদারী অপরাধের শামিল বিধায় এরূপ সুবিধা গ্রহণকারী চাঁদাবাজদের নিকটস্থ থানায় সোপর্দ করার জন্য নির্দেশ ক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে।
তাহলে কি আন্দোলনের নামে চলছে নিরব চাঁদাবাজি? প্রাথমিক শিক্ষকরা আজ বিপর্যস্ত। তাদের ন্যায্যদাবীর তালিকা ক্রমেই দীর্ঘায়িত হচ্ছে বাস্তবায়নের দিকে এগুতে পারছেনা। তার মূলে রয়েছে, বহুধাবিভক্ত সংগঠন, স্বঘোষিত নেতৃত্ব, শিক্ষক সংগঠনের অনৈক্য, নেতৃত্বের অহংকার ও অসহিষ্ণু মনোভাব। অনেকটা "গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল" বা "ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সরদার" এসব প্রবাদের সাথে যেন একাকার।
ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের বা সংগ্রামের মানসিকতা না থাকলেও তাদের মধ্যে দালালি বা চামচামির ক্ষেত্রে ঐক্যের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয় না। স্বঘোষিত এসব প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির নেতারা এখন চাঁদাবাজি তেলবাজির শীর্ষে। দুঃখ জনক হলেও সত্য আজ বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সংগ্রাম, সাফল্য ও প্রেরণার ৫৩ বছরের প্রান্তে দাঁড়িয়ে এভাবেই মূল্যায়ন করতে হচ্ছে।
জাকির আহমদ খান কামাল
প্রধান শিক্ষক ও কলাম লেখক
মোবাইল :০১৭১২৮৭৬৪৩৪