রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৯ ভাদ্র ১৪৩২
শিরোনাম
বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে বিভক্তি, নারী ভোটারের আধিক্য ও জাতীয় নির্বাচনের প্রভাব বিবেচিত হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন

বর্তমান প্রেক্ষাপটে ডাকসু নির্বাচন: রাজনৈতিক আবহাওয়ার ব্যারোমিটার


  এ কে এম আজিজুর রহমান

প্রকাশ :  ২৩ আগস্ট ২০২৫, ০৬:০৮ বিকাল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)

নির্বাচন কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব নির্বাচনের বিষয় নয়; এটি দেশের ছাত্র সমাজের আকাঙ্ক্ষা, রাজনৈতিক বিন্যাস ও সামগ্রিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ দর্পণ। ২০২৫ সালের এই নির্বাচন এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে যখন দেশ একটি রক্তক্ষয়ী গণ-আন্দোলনের স্মৃতি বহন করছে, যা এই নির্বাচনের গুরুত্ব ও তাৎপর্যকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। ১৯২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে প্রতিষ্ঠিত ডাকসু বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির এক গৌরবময় অধ্যায়ের সাক্ষী। ৫২'র ভাষা আন্দোলন, ৬৬'র ছয় দফা, ৬৯'র গণ-অভ্যুত্থান, ৭১'এর মুক্তিযুদ্ধ এবং ৯০'এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে এই সংসদের ভূমিকা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। তবে বিগত তিন দশকে মাত্র দু'বার (২০১৯ ও ২০২৫) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় এই প্রতিষ্ঠানটির গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা ব্যাহত হয়েছে। ২০২৫ সালের এই নির্বাচন তাই ছাত্র গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবনের একটি সম্ভাবনা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

এবারের নির্বাচনে আটটি পূর্ণাঙ্গ প্যানেলসহ মোট ১৪টি সংগঠন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী প্যানেলগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, ইসলামী ছাত্রশিবির, ছাত্রদল, বামজোট এবং কয়েকটি স্বতন্ত্র প্যানেল।

২০২৫ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ২৮ টি পদের জন্য মোট ৪৬২ জন প্রার্থী ডাকসুর বিভিন্ন ভাবে পদে প্রাথমিকভাবে বৈধতা পেয়েছেন। ৪৭টি মনোনয়নপত্র ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় স্থগিত হয়েছে। সহ-সভাপতি (ভিপি) পদপ্রার্থী ৪৮ জন এর মধ্যে ছাত্র ৪৩ জন ,ছাত্রী পাঁচজন এবং সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে প্রার্থী ১৯ জন, ছাত্র আঠারো জন ,ছাত্রী একজন ।ডাকসু নির্বাচনকে ঘিরে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ  দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন প্যানেল তাদের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করলেও, শিক্ষার্থীরা তাদের ভোটের মাধ্যমে যোগ্য ও নির্বাচিত করতে চান। তবে অন্যান্য প্যানেলের তুলনায় এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্যানেলটির বিভিন্নতা (ডাইভারসিটি )ও অন্তর্ভুক্তিমূলক (ইনক্লিউশন ) বিবেচনায় ক্যাম্পাসে বেশ আলোচিত হচ্ছে বলে অনেকে মনে করেন।

তবে বর্তমানে সর্বাধিক আলোচিত বিষয় হলো সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে উদ্ভূত শক্তিগুলোর মধ্যে বিভক্তি। আন্দোলনটি এখন তিনটি ভিন্ন প্যানেলে বিভক্ত: ‘বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ’, ‘স্বতন্ত্রঐক্যজোট’ (আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমার নেতৃত্বে) এবং ‘ডিইউ ফার্স্ট’ (আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক ও নাগরিক পার্টির যুগ্ম-মহাসচিব মাহিন সরকারের নেতৃত্বে)। এই বিভক্তি নতুন রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে ঐক্য বজায় রাখার চ্যালেঞ্জকেই তুলে ধরে।নির্বাচনী কর্মকাণ্ড ইতিমধ্যেই জোরেশোরে শুরু হয়ে গেছে। ডাকসুর ২৮টি পদের জন্য ৬৫৮টি এবং ১৮টি আবাসিক হলের সংসদ নির্বাচনের জন্য ১৪২৭টি মনোনয়নপত্র বিক্রি হয়েছে। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হলে সর্বোচ্চ ১১২টি এবং বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলে সর্বনিম্ন ৩৩টি মনোনয়নপত্র বিক্রি হয়েছে। মনোনয়ন বাছাই, প্রার্থীতা প্রত্যাহার ইত্যাদি ধাপ পেরিয়ে ৯ সেপ্টেম্বর ভোটগ্রহণের মাধ্যমে চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারিত হবে।এবারের নির্বাচনে নারী ভোটারদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মোট ৩৯,৭৭৫ জন ভোটারের মধ্যে ১৮,৯০২ জনই ছাত্রী, যা মোট ভোটারের ৪৭.৫%। ২০১৯ সালের নির্বাচনে নুরুল হক নুর ও আখতারের জয়ে পাঁচটি হলের নারী ভোটাররা নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেছিলেন। এবারও উমামা ফাতেমা, মিতু আক্তার এবং ১৫ জুলাইয়ের সহিংসতায় আহত সানজিদা আহমেদ তান্নীর মতো বেশ কয়েকজন নারী প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, যা নির্বাচনের গতিপ্রকৃতিকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। নির্বাচনকে ঘিরে ছাত্রদের মধ্যে বেশ কিছু প্রত্যাশা ও দাবি উচ্চারিত হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ছাত্র রাজনীতিকে সত্যিকার অর্থে ছাত্র-কেন্দ্রিক করা, ২০২৪ সালের আন্দোলনের চেতনা ও মূল্যবোধকে সংরক্ষণ করা, অতীতের ট্রমা ও সমস্যাগুলোর সমাধান করা এবং নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো যেন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় হারিয়ে না যায় তা নিশ্চিত করা।

নির্বাচনটি বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে দলীয় কোন্দল ও বিভক্তি, নির্বাচনী সততা নিয়ে উদ্বেগ এবং হলভিত্তিক ছাত্র রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে বিতর্ক।জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষিতে এই নির্বাচনের ফলাফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি নাগরিক পার্টির মতো নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি পরীক্ষার ময়দান হিসেবে কাজ করবে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে ডাকসু নির্বাচন একটি জটিল ও বহুমাত্রিক ঘটনা। এটি একদিকে যেমন দীর্ঘ ব্যবধান পর ছাত্র গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের একটি সুযোগ, অন্যদিকে তেমনই একটি উত্তাল ও আঘাতপ্রাপ্ত রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। একটি সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনই কেবল ছাত্র সমাজের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে এবং ডাকসুর গৌরবময় ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে। এই নির্বাচনের ফলাফল আগামী দিনের ছাত্ররাজনীতি এবং জাতীয় রাজনীতির গতিপথকেও প্রভাবিত করতে বাধ্য , কেননা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)। অবিভক্ত ভারতের ছাত্র রাজনীতি থেকে শুরু করে একাত্তরের স্বাধীনতার পূর্বাপর রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামের নানা বাঁকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে এ প্রতিষ্ঠানটি। জাতির সংকটকালে বারবার দেখিয়েছে মুক্তির দিশা। শতবর্ষী এ ডাকসু যেমন বহু মন্ত্রী-এমপির জন্ম দিয়েছে, আবার ডাকসুর ছাত্রনেতা থেকে অনেকে পরবর্তীকালে হয়ে উঠেছেন জাতীয় নেতা।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত