রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৯ ভাদ্র ১৪৩২
শিরোনাম

বিশ্ব মানবিক দিবসের প্রত্যাশা -প্রান্তিক শিশুদের উন্নয়নে ভূমিকা রাখুন


  এ কে এম আজিজুর রহমান

প্রকাশ :  ১৯ আগস্ট ২০২৫, ০৭:৫২ বিকাল

প্রতি বছর ১৯ আগস্ট বিশ্বজুড়ে পালিত হয় বিশ্ব মানবিক দিবস। এ দিনটি কেবল মানবিক সাহায্যকর্মীদের আত্মত্যাগ ও অবদানকে স্মরণ করার জন্য নয়, বরং মানবিক সংকটে থাকা কোটি মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের দায়িত্বের কথাও মনে করিয়ে দেয়।

২০০৩ সালের এই দিনে ইরাকের বাগদাদে জাতিসংঘের কার্যালয়ে এক ভয়াবহ বোমা হামলায় প্রাণ হারান জাতিসংঘের বিশেষ দূত ব্রাজিলীয় কূটনীতিক সেরগিও ভিয়েরা দে মেলোসহ ২২ জন সহকর্মী। প্রায় তিন দশক ধরে তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে মানবিক সহায়তা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেছেন। তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে জাতিসংঘ ২০০৮ সালে ১৯ আগস্টকে বিশ্ব মানবিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। পরের বছর থেকেই এ দিবসটি আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হতে থাকে। সম্প্রতি হৃদয়বিদারকভাবে সামনে আসে গাজার মানবিক বিপর্যয়। এখানে যারা মানবিকতাকে ঊর্ধ্বে রেখে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম সাবেক ফিলিস্তিনি ফুটবলার সুলেমান আল-ওবেইদ, যিনি “ফিলিস্তিনি পেলে” নামে পরিচিত ছিলেন। দক্ষিণ গাজায় মানবিক সহায়তার অপেক্ষায় থাকা অবস্থায় ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় তিনি নিহত হন। তার মৃত্যুতে উয়েফা (UEFA) শোক প্রকাশ করে এবং পরবর্তীতে একটি ফুটবল ম্যাচে খেলোয়াড়রা হাতে তুলে নেন একটি ব্যানার - “শিশু হত্যা বন্ধ করো, বেসামরিক হত্যা বন্ধ করো।” এই ঘটনা প্রমাণ করে, মানবিক সংকট কেবল ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীকেই নয়, বরং আন্তর্জাতিক বিবেক ও ক্রীড়াঙ্গনকেও গভীরভাবে নাড়া দিচ্ছে। তাছাড়া গাজার বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থার মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল, চিকিৎসক ড. মুহাম্মদ আবু সালমিয়া, এবং চিকিৎসক খলিল আল-দাখরানসহ অসংখ্য ত্রাণকর্মী গাজায় নিহত হয়েছেন। তাদের প্রত্যেকের আত্মত্যাগ বিশ্ব মানবিকতার ইতিহাসে এক অনন্ত আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবে।

আজকের পৃথিবীতে মানবিক সংকটের গভীরতা অভূতপূর্ব। যুদ্ধ ও সংঘাতের কারণে বর্তমানে ১০৩ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত, প্রতিবছর প্রায় ৬৮ হাজার মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণ হারায়, এবং ১৩০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। জলবায়ু পরিবর্তন, অর্থনৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিরতা একত্রে মানবিক বিপর্যয়কে আরও জটিল করে তুলছে। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো, এমন ভয়াবহ প্রেক্ষাপটেও জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা কার্যক্রম চলছে চরম অর্থসংকটে। ২০২৫ সালের জন্য প্রয়োজনীয় ২৯ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে মাত্র ১৩% তহবিল সংগ্রহ হয়েছে। অথচ, স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (সিপ্রি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বিশ্বজুড়ে সামরিক ব্যয় রেকর্ড পরিমাণে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২.৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ৯.৪% বেশি। এই বৈপরীত্যই সবচেয়ে বড় মানবিক প্রশ্ন উত্থাপন করে।এর প্রভাব সবচেয়ে ভয়াবহভাবে পড়ছে গাজা, সুদান, ইউক্রেন, মিয়ানমারসহ যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলের অসহায় মানুষের ওপর। গাজায় ইসরায়েলি অবরোধের কারণে শিশুদের খাদ্য, পানি ও চিকিৎসা সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা কমে যাওয়ায় শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির হার ২৭% বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু তাই নয়, কক্সবাজারে প্রায় ২.৩ লাখ রোহিঙ্গা শিশু শিক্ষা সংকটে রয়েছে, যেখানে ৮৩% শিশুর শিক্ষার ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে।  বাংলাদেশেই রয়েছে প্রায় ২০ লাখ পথশিশু, যাদের অধিকাংশই মানসিক আঘাত ও সামাজিক অনিশ্চয়তায় ভুগছে।

এই চিত্র আমাদের সামনে এক নির্মম সত্য উন্মোচিত করে- মানবিক সহায়তার ঘাটতি সরাসরি শিশুদের জীবন, ভবিষ্যৎ ও স্বপ্নকে গ্রাস করছে। জাতিসংঘ ইতোমধ্যেই সতর্ক করেছে, দাতা দেশগুলোর অব্যাহত সহায়তা ছাড়া জীবনরক্ষাকারী সেবাগুলো হ্রাস পাবে এবং বিশ্বব্যাপী মানবিক বিপর্যয় আরও তীব্র আকার ধারণ করবে। তাদের ভাষায়, বর্তমান সহায়তা হলো—“সাগরে এক ফোঁটা পানির মতো।”

কূটনীতিক টম ফ্লেচার যথার্থই বলেছেন “এটি কেবল অর্থের প্রশ্ন নয়, বরং মানবিক দায়িত্ব ও বৈশ্বিক সংহতির প্রতীক।” আসলেই, আজকের পৃথিবীতে কোনো সংকটই এককভাবে কোনো দেশ বা সংস্থার দ্বারা সমাধান করা সম্ভব নয়। প্রতিটি সংকট অন্য সংকটের সঙ্গে জড়িত, এবং তার প্রভাব সীমান্ত অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়ে। তাই ন্যায্য তহবিল বণ্টন, কার্যকর সমন্বয় ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া মানবিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সম্ভব নয়।

বিশ্ব মানবিক দিবসের আসল শিক্ষা এখানেই- আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ হতে হবে সহযোগিতার, প্রতিটি সহায়তা হতে হবে সংহতির প্রতীক কারণ মানবিক সহযোগিতা শুধু সংকটাপন্ন মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য নয়, এটি আমাদের সভ্যতার মানবিকতার পরীক্ষাও।

এ.কে.এম.আজিজুর রহমান
শিশু উন্নয়ন কর্মী।  

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত