শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫, ১১ শ্রাবণ ১৪৩২
শিরোনাম

পোনামাছ নিধনকারীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জরুরী


  জাকির আহমদ খান কামাল

প্রকাশ :  ২৩ জুলাই ২০২৫, ১২:৪২ দুপুর

"অভয়াশ্রম গড়ে তুলি
দেশি মাছে দেশ ভরি" 

এ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে সারা দেশে কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত একযোগে পালিত হচ্ছে জাতীয় মৎস সপ্তাহ ২০২৫। এ উপলক্ষে সপ্তাহব্যপী বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহন করেছে মৎস্য সম্পদ অধিদপ্তর। কর্মসূচীগুলো হল র‌্যালি, সেমিনার, মাছ অবমুক্তকরণ, প্রচারাভিযান, মৎস্যচাষী সম্মাননা ইত্যাদি। জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ একটি অনুষ্ঠান নয়, এটা আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা ও ভবিষ্যত উন্নয়ন পরিকল্পনার সহায়ক শক্তি।

মাছের অভয়াশ্রম হল দেশের নদী, নালা, খাল, বিল, হাওর, বাওর বা অন্য কোনো জলাশয়ের একটি নির্দিষ্ট অংশ যেখানে মাছের প্রজনন বংশবৃদ্ধি ও নিরাপদ আবাস নিশ্চিত করার জন্য মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়। যার ফলে মাছের সংখ্যা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে, কারণ এখানে মাছ ডিম পাড়ে এবং বাচ্চা ফোটায়। এটি প্রাকৃতিক মাছের প্রজাতি সংরক্ষণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। 

অভয়াশ্রম স্থাপনের ফলে মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন বৃদ্ধি পায় এবং এর ফলে মাছের সংখ্যাও বাড়ে। এটি মাছের বিভিন্ন প্রজাতিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করে। আশেপাশে অন্যান্য জলাশয়ে মাছ ছড়িয়ে পড়ে, ফলে স্থানীয় মৎস্যজীবীরাও উপকৃত হন। 

দেশী মাছের নিরাপদ প্রজনন ও আবাসস্থল নিশ্চিতকরণ, জলাশয়ে টেকসই উৎপাদন অব্যাহত রাখা, মাছের প্রজাতিগত ও জেনেটিক বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ, জলজ পরিবেশ ও ইকোসিস্টেম সংরক্ষণ, পুনরুদ্ধারে নির্দিষ্ট স্থানে মাছ আহরণ যেন না করা যায় এজন্য গাছের ডালপালা, বাঁশ ইত্যাদি স্থাপন করা হয়। এতে করে সেখানে মাছ নিরাপদ আশ্রয় পায়, মুক্তভাবে বিচরণ করতে পারে ও অবাধ প্রজনন ঘটাতে পারে ।

আমরা "মাছে ভাতে বাঙ্গালী" হিসেবে পরিচিত। কালক্রমে আমাদের কতিপয় ভোজন বিলাসীদের মনোরঞ্জনে ডিমওয়ালা মাছ নিধন, পোনা মাছ নিধন, মাছ ধরার জন্য অবৈধ জাল ব্যবহার, জলাশয় সেচে শেষ মাছটি নিধন ইত্যাদি নানা কারনে দেশীয় প্রজাতির মাছ প্রায় বিলুপ্তির পথে। আরো উদ্বেগের বিষয় হলো বর্ষার প্রারম্ভেই লক্ষ করা যায় কিছু অসাধু মাছ শিকারী কুইয়া জাল দিয়ে টাকী মাছ, শোল মাছ সহ অন্যান্য মাছের পোনা ধরায় লিপ্ত রয়েছে। পাশাপাশি চায়না বাইর দিয়ে ছোট মাছগুলো নিধন করে ফেলছে। আমরা যদি একটু সচেতন না হই তাহলে দেখা যাবে দেশীয় মাছ একদিন চিরতরে হারিয়ে যাবে।

প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকে ঘোষনা দিয়ে সতর্ক করা মাঝে মাঝে অবৈধ মাছ ধরার সামগ্রী ধ্বংস করা হলেও এসব পোনা নিধন বন্ধ হচ্ছ না। অনেকের ধারণা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আইনের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। তাছাড়া শুধু প্রশাসনের দিকে না তাকিয়ে এগুলোকে সামাজিক ভাবে প্রতিরোধ করার সময় এখনই। আমরা জানি পোনা মাছ মারে যারা, দেশের ক্ষতি করে তারা। তাই দেশের ক্ষতির কাজ যারা করবে তাদের প্রতিহত করার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। 

সমাজভিত্তিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ ও এর সঙ্গে সম্পর্কিত মৎস্যজীবীর জীবন-জীবিকার রক্ষার্থে এবং উন্নয়নে দেশের বিভিন্ন নদ-নদী ও অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে ৬৬৯টি অভয়াশ্রম পরিচালিত হচ্ছে।

হাওরে ১০টি স্থায়ী, ইলিশের জন্য ৬টি, হালদা নদীতে ১টি এবং কাপ্তাই হ্রদে ৬টি অভয়াশ্রম গড়ে তোলা হয়েছে, যা মৎস্যজীবীরাই পরিচালনা করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। 

যদিও অনেক জলাশয়ে মাছের অভয়াশ্রম গড়ে উঠেছে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। অতীতে প্রাকৃতিকভাবে এদেশের অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়সমূহে বিভিন্ন প্রজাতির প্রচুর মাছ ধরা পড়ত। ষাটের দশকে এর পরিমাণ ছিল মোট মৎস্য উৎপাদনের ৮০% । বিগত কয়েক দশকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অতিরিক্ত পানি ব্যবহার, কৃষিকাজে কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার, শিল্পায়নের ফলে পানি দূষণ, অতিরিক্ত মৎস্য আহরণ, নির্বিচারে ডিমওয়ালা ও পোনা মাছ নিধন, নদীতে অপরিকল্পিত বাঁধ ও অবকাঠামো নির্মাণ এবং পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার কারণে বর্তমানে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয় হতে এ উৎপাদন নেমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩৫% এ । বাকি উৎপাদনের ৪৭% আসে বিভিন্ন বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ থেকে এবং ১৮% আসে সামুদ্রিক মৎস্য হতে। মুক্ত জলাশয়ে শুধু উৎপাদনই নয় সে সাথে মাছের জীববৈচিত্র্যও দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে মোট ২৬০ প্রজাতির স্বাদুপানির মাছের মধ্যে ১২টি চরম বিপন্ন, ২৮টি বিপন্ন ও ১৪টি ঝুঁকিপূর্ণ প্রজাতি হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। যে প্রজাতি প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে অচিরেই বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকি মোকাবেলা করছে তাকে চরম বিপন্ন প্রজাতি যেমন- সরপুঁটি, মহাশোল, বাঘাআইড়, আর যে প্রজাতি অদূর ভবিষ্যতে বিলুপ্ত হবার ঝুঁকি মোকাবেলা করছে তাকে বিপন্ন প্রজাতি বলে। অন্যদিকে যে প্রজাতি বিপন্ন না হলেও মধ্যমেয়াদি ভবিষ্যতে বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে তাকে ঝুঁকিপূর্ণ প্রজাতি বলে। বাংলাদেশের কয়েকটি বিপন্ন প্রজাতির মাছের মধ্যে রয়েছে রানি, পাবদা, টেংরা, খলিশা, বেদাইশ্যা ইত্যাদি । আর ঝুঁকিপূর্ণ প্রজাতি হচ্ছে ফলি, গুলশা, কাজলি, মেনি, রিটা ইত্যাদি। মুক্ত জলাশয়ে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য মাছের নিরাপদ আবাসস্থল বা অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি  অবৈধভাবে পোনামাছ নিধনের অপকৌশল গুলো বন্ধ করা এবং পোনামাছের নিরাপত্তা বিধানকল্পে  যারা এ সব কাজে জরিত তাদেরকে আইনের আওতায় আনা জরুরি ।

দেশের আপামর জনগোষ্ঠীর নিরাপদ আমিষ ও পুষ্টির চাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি সম্প্রসারণ, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন তথা দেশের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মৎস্য খাতের অবদান অনস্বীকার্য। নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর, ডোবা, হাওর-বাওড় নিয়ে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয় আছে ৩৮.৬ লক্ষ হেক্টর, আর বদ্ধ জলাশয় আছে ৮.৫ লক্ষ হেক্টর এবং দক্ষিণের সুবিস্তৃত ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সামুদ্রিক জলসীমা আমাদের মৎস্য সম্পদের উৎস। মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ, উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা, টেকসই উৎপাদন ও বিপণনে সরকার কার্যকর, সময়োপযোগী, কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও যথাযথ বাস্তবায়ন প্রয়োজন।  

মৎস্য খাত থেকে দেশের মোট জিডিপির ২.৫৩ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপির ২২.২৬ শতাংশ অর্জিত হয়ে থাকে। ১২ লাখ নারীসহ প্রায় ২ কোটি অর্থাৎ মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১২ শতাংশের অধিক মানুষের জীবন ও জীবিকা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মৎস্য খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমিষের চাহিদা মেটানোর দিক থেকেও মাথাপিছু দৈনিক ৬৭.৮০ গ্রামে উন্নীত হয়েছে। মাথাপিছু আমিষ গ্রহণের পরিমাণ পর্যায়ক্রমে আরও বাড়ানো প্রয়োজন ।
        
বিজ্ঞানভিত্তিক ও পরিবেশবান্ধব মৎস্য আহরণ, মৎস্য চাষ এবং সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে দেশীয় প্রজাতির মাছ; যেমন- রুই, কাতলা, মৃগেল, পুঁটি, ডানকানা, টেংরা, কৈ, শিং, মাগুর, বোয়াল, আইড়সহ অন্যান্য বিপন্ন বা বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির মাছের অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠা ও এর টেকসই ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।

বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে মৎস্য খাতের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। প্রাণীজ আমিষের চাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে এ খাত জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। সরকারের পাশাপাশি এ খাতের উন্নয়নে সমাজ সচেতন ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক ব্যক্তি, শিক্ষক, ছাত্র, পেশাজীবি, সাংবাদিক সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে এসে পোনামাছ নিধনকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। 


জাকির আহমদ খান কামাল 
প্রধান শিক্ষক (অবঃ) ও কলাম লেখক।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত