বুধবার, ০৪ জুন ২০২৫, ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
শিরোনাম

এনবিআর বহির্ভূত করের লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি: যেসব ফি বাড়ছে


  আরবান ডেস্ক

প্রকাশ :  ০২ জুন ২০২৫, ১২:৪০ দুপুর

আগামী অর্থবছরের বাজেটে বিভিন্ন ধরনের মাশুল (ফি), সুদ, মুনাফা, স্ট্যাম্প বিক্রি, টোল, ইজারা, ভাড়া ইত্যাদির হার বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এনটিআর থেকে ৪৬ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ রয়েছে সরকারের। তবে এই খাত থেকে শেষ পর্যন্ত কত রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হয়, তা জানার জন্য অর্থবছর শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

আগামী অর্থবছরের জন্য লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ৫০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। শুধু এনবিআরবহির্ভূত কর আয় লক্ষ্যমাত্রা ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ছিল। ধারাবাহিকভাবে এই লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে। বাস্তবে গত পাঁচ অর্থবছর ধরে এই আয় বার্ষিক ৬ হাজার কোটি থেকে ৮ হাজার কোটি টাকার মধ্যে হয়েছে।

সরকারের রাজস্ব আয়ের প্রধান তিনটি উৎস হচ্ছে আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) ও শুল্ক। এ উৎসগুলো থেকে আয় সংগ্রহের দায়িত্ব জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর)। এর বাইরেও অন্যতম একটি খাত রয়েছে সরকারের রাজস্ব আয় সংগ্রহের, যেটাকে সরকার বলে কর ছাড়া প্রাপ্তি (নন-ট্যাক্স রেভিনিউ), সংক্ষেপে যা এনটিআর নামে পরিচিত।

অর্থ বিভাগ সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে চিঠি দিয়ে বলেছে, সেবা মাশুল তিন বছর পরপর অথবা প্রয়োজনের নিরিখে যথাসময়ে হালনাগাদ হবে। তবে সেগুলো করা হবে সেবা দেওয়ার খরচ, জীবনযাত্রার মান, মূল্যস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয় বিবেচনায় রেখে। আগামী ২ জুন টেলিভিশনের পর্দায় বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। তাতে এনটিআর থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা আদায়ের কথা বলা থাকবে। তবে মাশুল বৃদ্ধির কথা বাজেট বক্তব্যে উল্লেখ করবেন না তিনি।

সূত্রগুলো জানায়, আগামী অর্থবছরের বাজেটে তৃণমূল থেকে জেলা পর্যায় পর্যন্ত হাটবাজারের ইজারা মূল্য কিছুটা বাড়তে পারে। মোবাইল কোর্টসহ যেসব খাতে সরকার জরিমানা ও দণ্ড আরোপ করে, বাড়তে পারে সেগুলোও। এক্সপ্রেসওয়ে, উড়ালসড়কসহ বিভিন্ন সেতু পারাপারের টোল, সেবা ও প্রশাসনিক মাশুল ইত্যাদির হারও কিছুটা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দিক থেকে বাজেটে রাজস্ব বৃদ্ধির চাপ রয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় রাজস্ব সংগ্রহের হার ৮ শতাংশের কম। দেশে ডলারসংকট দেখা দিলে ২০২২ সালে আইএমএফ থেকে ঋণ নেওয়ার উদ্যোগ নেয় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। সরকারের আবেদনে ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ অনুমোদন করে আইএমএফ। ঋণ কর্মসূচি অনুমোদনের সময় আইএমএফ বলে দিয়েছিল, বাংলাদেশকে রাজস্ব-জিডিপির হার বছরে দশমিক ৫ শতাংশ হারে বাড়াতে হবে।

এনটিআরের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করার সময় আইএমএফের এই শর্তের কথাও বিবেচনায় রাখা হয়েছে বলে অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান। অর্থ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কাঁচা পাট ও পাটপণ্য রপ্তানিতে সামান্য রাজস্ব মাশুল ছিল, যা ৩০ বছর আগে ধার্য করা। সম্প্রতি হার বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়ায় বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় নিজেই তা প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়েছে। অথচ আগামী বাজেট প্রণয়নের অংশ হিসেবে কয়েক মাস ধরেই বিভিন্ন টোল ও মাশুল বৃদ্ধির বিষয়ে অর্থ বিভাগ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের সঙ্গে আলোচনা করেছে।

এনটিআরের মধ্যে বড় ১০টি উৎস রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে লভ্যাংশ ও মুনাফা। ব্যাংক-বিমাসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের বিপরীতে সরকার লভ্যাংশ ও মুনাফা পায়। চলতি অর্থবছরে লভ্যাংশ ও মুনাফা থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা হলো ৭ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরে এই লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা।

সরকার, সরকারি কর্মচারী, বিভিন্ন আর্থিক ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া ঋণের বিপরীতে সুদ পাওয়া যায়। চলতি অর্থবছরে এই খাত থেকে ৬ হাজার ১১৪ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। আগামী অর্থবছরে এই লক্ষ্যমাত্রা আরও বাড়ানো হচ্ছে। আইন ও নিয়মনীতির পরিপন্থি বিভিন্ন কাজের জন্য সরকার জরিমানা, দণ্ড ও বাজেয়াপ্তকরণ করে প্রতিবছর কিছু অর্থ আয় করে থাকে। চলতি অর্থবছরে ৬৪৩ কোটি টাকা আদায় লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও আগামী অর্থবছরে এ খাত থেকে আয় ধরা হচ্ছে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা।

সরকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জনগণকে দেওয়া সেবার বিপরীতে আয় করে। যেমন আমদানি-রপ্তানি সনদের মাশুল, কোম্পানি নিবন্ধন মাশুল, বিমা প্রিমিয়াম, সমবায় সমিতিগুলোর নিরীক্ষা মাশুল, নিবন্ধন ও নবায়ন মাশুল ইত্যাদি। এসব সেবার বিপরীতে সরকার আগামী অর্থবছরে ১০ হাজার কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়।

এ ছাড়া সরকার আগামী অর্থবছরে হাট-ঘাট ভাড়া ও ইজারা দিয়ে হাজার কোটি টাকা, টোল ও লেভি থেকে আরও হাজার কোটি টাকা, মূলধন রাজস্ব অর্থাৎ পুরোনো গাড়ি বা আসবাব নিলামে বিক্রি থেকে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা আদায় করতে চায় বলে অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। দেশে চলমান অর্থনৈতিক সংকটময় পরিস্থিতির কারণে সরকারের রাজস্ব আয় চাপে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে এনবিআরবহির্ভূত কর আয় ও করবহির্ভূত রাজস্ব আয়ে জোর দেওয়া হয়েছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র ফেলো মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজস্ব বাজেটে কোনো উদ্বৃত্ত নেই। এর ফলে দিন যত যাবে, আমাদের পরনির্ভরশীলতা তত বাড়বে। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ হলে ঋণের সুদহার অনেক বেড়ে যাবে। এ অবস্থায় রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত না বাড়ালে বড় রকমের সমস্যা সৃষ্টি হবে।

তিনি বলেন, এনবিআরবহির্ভূত আয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে ডিজিটাইজেশনের কোনো বিকল্প নেই। এই প্রক্রিয়া এনবিআরের সঙ্গে সমন্বয় করে করলে আরও জোরদার হবে। অটোমেশন হলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হলে অনেক আয় বাড়বে।

‘শুধু এনবিআরের ওপর রাজস্ব আদায় বাড়াতে চাপ বাড়ালে হবে না’ উল্লেখ করে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মো. আবদুল মজিদ বলেন, ‘অন্যসব রাজস্ব আদায় বাড়াতেও জোর দিতে হবে।’

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত