বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২
শিরোনাম

শ্যামগঞ্জে আসলে কী ঘটে ছিল ৪ আগস্ট? অনুসন্ধানে অভিযোগের কোন সত্যতা মেলেনি


  মো: জায়েজুল ইসলাম

প্রকাশ :  ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৪৫ দুপুর

নেত্রকোণার পূর্বধলা উপজেলার ইউএনও মো. খবিরুল আহসানের বিরুদ্ধে সম্প্রতি অভিযোগ এসেছে, তাঁর নির্দেশে গত ৪ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশ গুলি চালিয়ে তিনজন আন্দোলনকারীর শরীর ঝাঁঝরা করে দেয়। এ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অভিযোগের সুত্রধরে গত ১৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় “গুলির নির্দেশ দেন ইউএনও” এই শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। খবরে জানা যায়, ওই অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। খবরটি জানাজানি হলে পূর্বধলাবাসী বিস্মিত হয়। কারণ ৪ আগস্ট উপজেলার শ্যামগঞ্জ বাজারে পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ হলেও সেখানে গুলি করা বা গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা আগে কখনোই শোনা যায়নি। এ নিয়ে তখনকার সময়ে প্রকাশিত দেশের বিভিন্ন পত্রিকার খবরেও শ্যামগঞ্জে আন্দোলনকারীদের কেউ গুলিবিদ্ধ হয়েছে বলে খবর আসেনি। তাহলে কি ঘটেছিল সেই দিন? জনস্বার্থে প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করতে নামে আজকের আরবান। 

১৩ ডিসেম্বর অভিযোগপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী উল্লেখ করা হয়, গত ৪ আগস্ট পূর্বধলা উপজেলার গোহালাকান্দা ইউনিয়নের জালশুকা শ্যামগঞ্জ বাজারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেন এই কর্মকর্তা। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ৪ আগস্ট আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মীদের হাতে থাকা রামদা ও বিভিন্ন দেশি অস্ত্রসহ পুলিশ ও আনসার বাহিনী সঙ্গে নিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেন ইউএনও। নির্দেশনা পেয়ে উপজেলার যুবলীগ ও ছাত্রলীগ ক্যাডাররা প্রকাশ্যে আনসার ও পুলিশের কাছ থেকে ৯টি অস্ত্র নিয়ে আন্দোলনরতদের ওপর গুলি ছোড়ে। এতে মানিকদি গ্রামের কলেজছাত্র শাকিব হাসানসহ তিনজনের শরীর ঝাঁঝড়া ও ৫-৬ জনের চোখ নষ্ট হয়ে যায়। এ ছাড়া ৭০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়। আন্দোলন চলাকালীন শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় গত ২৬ অক্টোবর পূর্বধলা উপজেলা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের ১৫ জনের নামে পূর্বধলা থানায় মামলা করা হয়।

বাংলাদেশ প্রতিদিনের এমন খবরে পূর্বধলা উপজেলায় ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। সংবাদটি সত্য নয় অবহিত করে অনেকেই বলছেন ওই সময়ের ঘটনায় প্রকাশিত খবরে এমনটি শোনা যায় নি।  প্রকাশিত রিপোর্ট ও অভিযোগের প্রেক্ষিতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. খবিরুল আহসান দাবী করেছেন প্রকাশিত সংবাদটি সম্পুর্ন মিথ্যা, বানোয়াট উদ্দেশ্য প্রনোদিত। একটি চক্র বিশেষ সুবিধা না পেয়ে অনেক আগে থেকেই আমার বিরুদ্ধে পরিচয় গোপন করে উর্ধ্বতনমহলসহ বিভিন্ন জায়গায় মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে আসছে। পূর্বেও এমন কয়েকটি অভিযোগের তদন্তে কোন সত্যতা মেলেনি। তাছাড়া তদন্তের সময় অভিযোগকারীদের খোঁজেও পাওয়া যায়নি। আর এ সকল অভিযোগের ধারাবাহিকতায় প্রধান উপদেষ্টা বরারর এই মিথ্যা অভিযোগটি করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, সম্প্রতি আমার অন্য উপজেলায় বদলীর অর্ডার হয়েছে। 

বিষয়টি সম্পর্কে উপজেলা গোহালাকান্দা ইউনিয়নের মানিকদি গ্রামে গিয়ে খোঁজ নিতে গেলে ওই গ্রামে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে আহত শাকিব হাসান নামে কাউকে পাওয়া যায়নি। 
মানিকদি গ্রামের মো. বাচ্চু মিয়া জানান, ৪ আগস্ট আন্দোলনের সময় ইটের আঘাতে তাদের গ্রামের আবুল হোসেনের পুত্র এমদাদুল হক চন্দন নামে একজন হ্যানট্রলি চালক আঘাত প্রাপ্ত  হয়েছিলেন। এছাড়া আর কেউ আঘাত পায়নি বা গুলিবিদ্ধ হয়নি।

আহত এমদাদুল হক চন্দন জানান, আন্দোলনের সময় তিনি বিএনপি ও ছাত্রদলের নেতা কর্মীদের সাথে আন্দোলনে ছিলেন। ৪ আগষ্ট আন্দোলনের সময় তাদের-আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগের সাথে ধাওয়া পাল্টাধাওয়া হচ্ছিল, এ সময় পুলিশ ফাঁকা আওয়াজ ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে। এক পর্যায়ে ইটের আঘাতে মুখের একপাশে তিনি আঘাতপ্রাপ্ত হন। পরে দলের নেতাকর্মীরা তাকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্থানীয় সমন্বয়ক ওমর ফারুক বলেন, বৈষ্যম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ইউএনও'র নির্দেশে পুলিশের গুলিতে ৩ জনের শরীর ঝাঁঝড়া হয়ে যাওয়ার নিউজটি জানতে পেরে খোঁজ নিতে গিয়ে এমন কাউকে পাইনি। আন্দোলনের সময় পুলিশ আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য কাঁদানে গ্যাস ছুড়লেও গুলি করার ঘটনা ঘটেনি এবং গুলিতে কেউ আহত হয়নি।    

গোহালাকান্দা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক ছায়েদ আল মামুন-শহীদ প্রকাশিত সংবাদের তথ্যটি ভুয়া উল্লেখ করে বলেন, ওইদিন পুলিশের গুলিতে তিনজনের শরীর ঝাঁঝড়া হয়ে যাওয়া তো দুরের কথা কেউই গুলিবিদ্ধ হয়নি। তবে আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগের হেলমেট বাহিনীর আক্রমন ও পুলিশের ছোড়া কাঁদানে গ্যাসে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছিল।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেকে বলেছেন ওইদিন নেত্রকোনা থেকে অস্ত্রবহনকারী একটি পুলিশের পিকআপ দুর্গাপুর যাওয়ার সময় শ্যামগঞ্জে ভগবতী মিষ্টান্ন ভান্ডারের কাছে আন্দোলনকারীদের সামনে পড়লে গাড়ি, অস্ত্র ভাংচুর করে এবং কিছু অস্ত্র নিয়ে যায়। পরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে অস্ত্র উদ্ধার করে। তবে ওইদনি পুলিশের গুলিতে কেউ আহত হয়নি।

পূর্বধলা থানার অফিসার ইনচার্জ ওসি মুহাম্মদ রিয়াদ মাহমুদ জানান, আমি আন্দোলন পরবর্তী সময়ে এখানে যোগদান করেছি। ওইদিনের ঘটনায় আমি কিছু বলতে পারবনা। 

৪ আগস্টের ঘটনায় পূর্বধলা থানায় ২৬ অক্টোবর দায়েরকৃত মামলায় আন্দোলনকারীদের কয়েকজন আহত হওয়ার কথা উল্লেখ করা হলেও গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়নি। 

তৎকালীন সময়ের নেত্রকোনা জেলার সার্কেল এসপি (পূর্বধলা) শিবলী সাদিক জানান, ওইদিন ঘটনাস্থল পরিদর্শনে পুলিশ গুলি ছুড়েছে বা পুলিশের গুলিতে কেউ আহত হয়েছে এমনটা কেউ বলেনি।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত