স্বাস্থ্য সহকারীদের মর্যাদা পুনর্বিবেচনা করা এখন সময়ের দাবী
জাকির আহমদ খান কামাল
প্রকাশ : ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ০২:৩৬ দুপুর

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের সাফল্যের গল্প
ইমিউনাইজেশনের সম্প্রসারিত কর্মসূচি (ইপিআই) ৭ই এপ্রিল ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন চারটি বিভাগের আটটি থানায় একটি পাইলট প্রকল্প হিসাবে চালু করা হয়েছিল এবং তখন থেকে এটি সরকারের সবচেয়ে সফল কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে, ইপিআই ছয়টি প্রচলিত ভ্যাকসিন প্রদান করেছে- বিসিজি, ডিপিটি, ওপিভি, টিটি এবং হাম। যাইহোক, প্রোগ্রামটি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিল কারণ টিকা কেন্দ্রগুলি সীমিত ছিল এবং প্রধানত শহরাঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবা সুবিধাগুলিতে অবস্থিত ছিল, যার ফলে ১৯৮৪ সালের মধ্যে কভারেজের হার ২% এর কম ছিল । ১৯৮৫ সালে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ গ্লোবাল ইউনিভার্সাল চাইল্ড ইমিউনাইজেশন ইনিশিয়েটিভ (UCI) এর প্রতি অঙ্গীকার করে এবং ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত EPI প্রোগ্রামকে জোরদার করার জন্য একটি ধাপ-ভিত্তিক প্রক্রিয়া শুরু করে। এই সময়ের মধ্যে, ৪৭৬টি উপজেলা, ৯২টি প্রধান পৌরসভা এবং ৬টি সিটি কর্পোরেশন জুড়ে ইপিআই কার্যক্রম তীব্র করা হয়েছিল। অবশেষে, ১৯৯০ সাল নাগাদ, শিশু এবং গর্ভবতী মহিলাদের সহ সমস্ত লক্ষ্য জনগোষ্ঠীর জন্য EPI পরিষেবাগুলি গুরুত্বসহকারে উপলব্দি করা হয়। ইপিআই প্রোগ্রামটি অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে শহর ও গ্রামের ঝুঁকিপূর্ণএলাকায় কভারেজ বাড়ানোর জন্য পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর ইপিআই-এর আওতাভুক্ত প্রধান টিকাগুলো হলো:
১। ব্যাসিলাস ক্যালমেট-গুয়েরিন(বিসিজি, যক্ষ্মা)
২। ডিপথেরিয়া, হুপিংকাশি, ধনুষ্টংকার (ডিপিটি) টিকা।
৩। পেন্টা (হেপাটাইটিস বি) পোলিওটিকা
৪। হাম ও রুবেলা টিকা (এমআর) হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ বি (এইচআইবি) টিকা
৫। হেপাটাইটিস বি (এইচপিভি) টিকা
৬। নিউমোকোকাল রোগ (পিএনসি) টিকা
৭। রোটাভাইরাস (রোটা) টিকা
৮। হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাস (এইচপিভি) টিকা
এই সব স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় স্বাস্থ্য সহকারীরা (Health Assistant) প্রতিনিয়ত গ্রাম থেকে গ্রামে গিয়ে এই সব স্বাস্থ্যসেবাসহ , গর্ভবতী মায়েদের পরামর্শ, স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধি, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে যাচ্ছেন। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, এই দায়িত্বশীল পেশাজীবীরা প্রশাসনিক কাঠামোয় এখনো ১৬ তম গ্রেড কর্মচারী হিসেবে গণ্য। শুধু তাই নয় যারা সিনিয়র কর্মচারী তাদের বেতনস্কেল তিনটি টাইম স্কেল পেয়ে দীর্ঘ দিন ধরে ১৩ তম গ্রেডের শেষ প্রান্তে। তাই তাদের বেতন বৃদ্ধি পাচ্ছে না।
অন্যদিকে, পশুসম্পদ বিভাগে যারা পশুর টীকা প্রদান করেন, তারা ১১ তম গ্রেড কর্মচারী হিসেবে স্বীকৃতি পান। এই বৈষম্য কেবল বেতন কাঠামো বা পদমর্যাদার বিষয় নয়—এটি মানবিক মর্যাদা ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির বিষয়। শিশুদের টীকা দেওয়া মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রোগমুক্ত রাখা, যা জাতির দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যনিরাপত্তার ভিত্তি। পশুসম্পদ বিভাগের কর্মীরা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন, কিন্তু মানুষের জীবনরক্ষা যে কাজটি করে যাচ্ছে স্বাস্থ্য সহকারীরা, তার গুরুত্ব আরও বেশি বলেই গণ্য হওয়া উচিত।
ইতোমধ্যে স্বাস্থ্যকর্মীরা নিয়োগবিধি সংশোধন, ইন সার্ভিস ট্রেনিংসহ ছয় দফা দাবিতে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি শুরু করেছিল। কিন্তু দেশের বৃহত্তর স্বার্থে টাইফয়েড টিকাদান ক্যাম্পেইনসহ অন্যান্য কার্যক্রম তারা যথাযথ ভাবে অব্যাহত রাখতে তাদের কর্মবিরতি স্থগিত করেছে । স্বাস্থ্য সহকারীরা বলেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছেন। একাধিকবার আশ্বাস দেওয়া হলেও এখনো দাবিগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। তাদের প্রধান দাবির মধ্যে রয়েছে-নিয়োগবিধি সংশোধন, ইন সার্ভিস ট্রেনিং এবং ১৪তম গ্রেডে আপগ্রেডেশন।
স্বাস্থ্য সহকারীরা সারাদেশে জাতীয় টিকাদান কর্মসূচির (EPI) মূল চালিকাশক্তি। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই বাংলাদেশ আজ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃত একটি সফল দেশ হিসেবে পরিচিত। তারা পাহাড়-পর্বত, চরাঞ্চল ও দুর্গম গ্রামে গিয়ে শিশুদের টীকা দিয়ে মহামারি প্রতিরোধ করেন, কিন্তু প্রাপ্য সম্মান ও পদমর্যাদা থেকে বঞ্চিত।
রাষ্ট্র যদি সত্যিই প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে গুরুত্ব দিতে চায়, তবে এই বৈষম্য দূর করতে হবে। মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্য সহকারীদের ন্যায্য মর্যাদা ও পদোন্নতির সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। তাদের প্রত্যাশিত শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে পুনর্বিন্যাস করা সময়ের দাবি, যা শুধু ন্যায্যতার স্বীকৃতি নয়, বরং স্বাস্থ্যসেবায় আরও অনুপ্রেরণা জোগাবার প্রয়োজনে।
জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে যারা দিনরাত কাজ করছেন, তারা যদি প্রাপ্য মর্যাদা না পান, তবে সেবার মানও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই সরকারের উচিত অবিলম্বে স্বাস্থ্য সহকারীদের তাদের প্রধান দাবির মধ্যে যেমন: নিয়োগবিধি সংশোধন, ইনসার্ভিসট্রেনিং,১৪তম গ্রেডে আপগ্রেডেশন, পদমর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা পুনর্বিবেচনা করা, যাতে মানবসেবায় নিয়োজিত এই সৈনিকরা আরও উদ্দীপনা নিয়ে দেশের সেবায় নিয়োজিত থাকতে পারেন।
জাকির আহমদ খান কামাল
প্রধান শিক্ষক (অবঃ) ও কলাম লেখক



_medium_1760246764.jpg)
